নায়িকা পরীমণির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। শুধু তাই নয়, পরীমণির মদকাণ্ডের তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। বোট ক্লাবে সেদিন এই নায়িকা প্রায় ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকার ব্লু লেবেলের চার বোতল মদ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে দুই বোতল ক্লাবেই পান করেন। আর বাকি দুটি সঙ্গে করে নিয়ে যান। কিন্তু এসব মদের দাম পরিশোধ করেননি তিনি।
ঘটনার সত্যতা পেয়ে ১৮ মার্চ এ প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা জেলার পরিদর্শক মো. মনির হোসেন। প্রতিবেদনে পরীমণি ও তার কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ বোগদাদী জিমি ওরফে জিমের বিরুদ্ধে বাদীকে (ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন) মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে অন্য আসামি ফাতেমা তুজ জান্নাত বনির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সূত্র থেকে জানা গেছে এ তথ্য।
নিমিষেই বোতলের মদ শেষ করে ফেলেন পরীমণি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ৮ জুন তুহিন সিদ্দিকি অমি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনানী কিংস বেকারি শপে অবস্থানকালে পরীমণির কস্টিউম ডিজাইনার জিমি তাকে ম্যাসেঞ্জারে কল করে বনানীর বাসায় যেতে অনুরোধ করেন। বাসায় যাওয়ার পর অমির সঙ্গে পরীমণি এবং ফাতেমা তুজ জান্নাত বনির সাক্ষাৎ হয়।
এরপর তারা অমির কাছে জানতে চান এত রাতে উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে কি না? উত্তরে অমি জানান, রাত বেশি হচ্ছে তাই এখন উত্তরা ক্লাবে যাওয়া যাবে না। তখন জিমি জানতে চান যে, তাহলে বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে কি না? জবাবে ঢাকা বোট ক্লাবে যাওয়া যাবে বলে জানান অমি। তখন পরীমণির অনুরোধে তারা চারজন অমির কালো রঙের জিপ গাড়িতে করে রাত ১২টা ২২ মিনিটে বোট ক্লাবে আসেন। গাড়ির পেছনে পরীমণির সাদা রঙের খালি জিপ গাড়ি ক্লাবে প্রবেশ করে।
ক্লাবের দোতলায় উঠে প্রথমে পরীমণি ও ফাতেমা তুজ জান্নাত বনি বারের সামনে থাকা টয়লেট ব্যবহার করে বারের ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর টিভির সামনের টেবিলে বসেন। টেবিলে অমিও বসেন। এসময় অমি পরীমণিদের স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার খাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু পরীমণি একটি এক লিটারের ব্লু-লেবেল মদের বোতল অর্ডার করেন। পরীমণি ও তার সঙ্গে থাকা জিমি এবং বনি নিমিষেই সেই বোতলের মদপান করে খালি করে ফেলেন। এরপর আরেকটি বোতলের অর্ডার করেন। তারা ওই বোতলের আংশিক মদপান করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আড্ডার একপর্যায়ে তাদের ২-৩ টেবিল পেছনে বোট ক্লাবের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নাছির উদ্দিন মাহমুদকে আরও দুজন ব্যক্তির সঙ্গে বসা দেখতে পান অমি। তখন পরীমণিকে নিয়ে নাছির মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন অমি। এরপর পুনরায় তাদের টেবিলে এসে বসে মদপানসহ গল্পগুজব করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর নাছির মাহমুদ ও তার সঙ্গে থাকা দুজন যখন বার থেকে চলে যাচ্ছিলেন, তখন পরীমণি নাছির মাহমুদকে ডেকে বললেন, ‘ভাই আমি আসলাম, আর আপনি এখুনি চলে যাচ্ছেন? আমাদের সঙ্গে আরেকটু বসেন। আসেন কিছুক্ষণ গল্প করি।’
তখন পরীমণির অনুরোধে নাছির মাহমুদ ফিরে এসে পুনরায় তার টেবিলে বসেন। কিছুক্ষণ পর ড্রিংকস শেষে পরীমণি ওয়েটারকে আরও এক লিটারের তিনটি ব্লু লেবেল মদের বোতলসহ দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দেওয়ার জন্য অর্ডার করেন। ওয়েটার তখন পরীমণিকে দুই বোতল ওয়াইন পার্সেল দিলেও ব্লু লেবেল মদের বোতল স্টকে না থাকায় পার্সেল দিতে পারেননি।
তখন ডিসপ্লেতে থাকা একটি ব্লু লেবেল বোতল পার্সেল করে দিতে বলেন পরীমণি। এসময় ওয়েটার জানান বোতলটি বিক্রির জন্য নয় এবং ক্লাবের মেম্বার ছাড়া পার্সেল দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরীমণি জোর করে ওই বোতল নিতে চান। আর হট্টগোল করতে থাকেন। একপর্যায়ে পরীমণি উত্তেজিত হয়ে দুই-তিনটি ব্যাংক কার্ড দেখিয়ে বলেন, ‘আমি কি ফকিরনি? আমার বিল আমি পরিশোধ করবো। আমি এটা নেবই।’
তখন পরীমণির সঙ্গে থাকা ফাতেমা বনি বলেন, ‘ওনাদের যদি রুলস থাকে, মেম্বার ছাড়া নেওয়া যাবে না, তাহলে তুমি নিও না।’
তখন পরীমণি বনিকে থাপ্পড় মেরে বলেন, ‘আমাকে দেখে কি মাতাল মনে হয়?’ পরীমণির সঙ্গে থাকা জিম তাকে শান্ত করতে গেলে তাকেও থাপ্পড় মারেন।
একপর্যায়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর থাকা গ্লাস, অ্যাশট্রে, বোতল ফ্লোরে এদিক ওদিক ছুঁড়তে থাকেন পরীমণি। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পরীমণিকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এতে পরীমণি আরও ক্ষেপে গিয়ে একটি অ্যাশট্রে তার দিকে ছুড়ে মারেন। যা তার ডান কানের ওপরে মাথায় লাগে। তখন নাছির মাহমুদ ক্লাবে পরীমণিকে সঙ্গে করে আনায় অমির ওপর রেগে যান এবং বলেন, ‘এরকম বেয়াদব মহিলা নিয়ে কেন ক্লাবে আসেন, কাল আপনার নামে নোটিশ হবে। এখুনি এদের নিয়ে বেরিয়ে যান।’
নাছির মাহমুদকে মারধর
তখন জিমি তেড়ে এসে নাছির মাহমুদকে গালমন্দ করতে করতে ২-৩টা কিলঘুসি মারেন। এরপর আবারও পরীমণি বারের ভেতরে গ্লাস ছুড়ে ভাঙচুর করতে থাকেন। একটি গ্লাস নাছির মাহমুদের বুকে লাগলে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি। এসময় নাছির মাহমুদ বোট ক্লাব ত্যাগ করে চলে যান। ক্লাব ত্যাগ করার আগে পরীমণিকে ক্লাব ছেড়ে চলে যেতে বলার জন্য সিকিউরিটি গার্ডকে নির্দেশ দিয়ে যান। নাছির মাহমুদ আহত অবস্থায় ওই রাতে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
মদের দাম হয় ৮৭ হাজার টাকা
এদিকে বার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য সিকিউরিটি গার্ড পরীমণিকে বারবার বললেও তারা যেতে চাননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সিকিউরিটি গার্ড বারের লাইট ও এসি কমিয়ে দেয়। তারপরও পরীমণি যেতে না চাইলে অমি তাকে বার থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং পরীমণির সঙ্গে থাকা জিমি ও সিকিউরিটি গার্ড তাকে ধরে গাড়িতে তুলে দেন। ক্লাবে তাদের খাওয়া দুই বোতল ব্লু লেবেলের দাম ও পার্সেলে নেওয়া দুই বোতল ওয়াইনের দাম পরিশোধ না করেই তারা ক্লাব থেকে চলে যান। এই চারটি বোতলের দাম ৮৭ হাজার ৬৫০ টাকা। এছাড়া ক্লাবের বারের ভেতরে গ্লাস, অ্যাশট্রে, বোতল ভাঙচুর করায় আনুমানিক ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।
এর আগে ২০২১ সালের ৬ জুলাই ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসানের আদালতে নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে পরীমণিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।