বাংলাদেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ নাসিম মারা গেছেন। তার ছেলে তানভীর শাকিল জয় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তিনি গত ৫ জুন থেকে কোমায় ছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। তানভির শাকিল জয় শুক্রবার জানান, তার বাবা আগের মতোই আছেন। অবস্থার কোনো উন্নতি বা পরিবর্তন হয়নি।
আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসিম গত ১ জুন জ্বর-কাশিসহ করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন। রাতে করোনা পরীক্ষার ফল পজেটিভ আসে। শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় মোহাম্মদ নাসিমের ব্রেন স্টোক করেন। কয়েক ঘণ্টায় তার অস্ত্রোপচার সফল হয়। সফল অস্ত্রোপচার হলেও তার মাথার ভেতরে বেশ কিছু রক্ত জমাট বাধা ছিল। স্ট্রোকের পর থেকেই তিনি অচেতন অবস্থায় ভেন্টিলেশন সাপোর্টেই ছিলেন। এরই মধ্যে পরপর দুইবার করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রেজাল্ট আসলে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহ আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সাংবাদিকদের জনান, আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০ টায় বনানী কবরস্থান মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয় আগামীকালের জানাজায় দলীয়- নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে উপস্থিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা সবাই যে যার অবস্থান থেকে তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি যেহেতু দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছে, তাই দেশের এই পরিস্থিতিতে তার মরদেহ কোথাও নেয়া হবে না। আগামীকাল সাড়ে ১০ টায় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
মোহাম্মদ নাসিম এমপি’র মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পিতার মতোই মোহাম্মদ নাসিম আমৃত্যু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আর্দশকে ধারণ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছেন। সকল ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠায় তিনি অনন্য অবদান রেখেছেন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন দেশপ্রেমিক ও জনমানুষের নেতাকে হারাল। আমি হারালাম একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রসঙ্গত, গত ১ জুন নিউমোনিয়াজনিত সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হলে ফলাফল পজিটিভ আসে। তবে সম্প্রতি মোহাম্মদ নাসিমের পরপর তিনটি করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৫ জুন শুক্রবার ভোরে তার স্ট্রোক হয়। সেদিনই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রাজিউল হকের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার হয়। এর আগেও তার একবার স্ট্রোক হয়েছিল।
এক নজরে নাসিমের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন মোহাম্মদ নাসিম। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র ছিলেন। নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায় এম মনসুর আলী ও মা মোসাম্মৎ আমেনা মনসুরের ঘরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মনসুর আলী স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। নাসিম জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন। গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী নাসিম স্বাধীনতার পর ১৯৯৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কারাগারে মনসুর আলীকেও হত্যা করা হলে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন নাসিম। তখন কারাগারেও যেতে হয়েছিল তাকে। ১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। তখন সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপের দায়িত্বও পান তিনি। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। এরপর ১৯৯৬ ও ২০০১, ২০১৪, ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান নাসিম। পরের বছর মার্চে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তাকে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাসিম এক সঙ্গে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত। পরে মন্ত্রিসভায় রদবদলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলেও সেবার মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি নাসিমের। তবে পরের মেয়াদে ২০১৪ সালে তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেন শেখ হাসিনা। রাজনীতির পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নাসিম। ঢাকাসহ নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন।