অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে তারা কখন এই সরকারকে বিদায় দেবেন। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে তারা এই দায়িত্ব নিয়েছেন। সরকার সব শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করবে।
রোববার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এটাই জাতির উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদেরকে বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করব। আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীও এই লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে একটা টিম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।’
জাতীয় সংসদ নিবাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে সবাইকে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাব, যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাব। তারা যখন বলবে আমরা চলে যাব।’
সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেশবাসীকে অনুরোধ করব, একটা আলোচনা শুরু করতে, আমরা সর্বনিম্ন কী কী কাজ সম্পূর্ণ করে যাব, কী কী কাজ মোটামুটি করে গেলে হবে। এই আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক আলোচনা থেকেই আসবে।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো প্রশ্ন তুলব না। আমরা আপনাদের সকলের দোয়া চাই। যে ক’দিন আছি সে সময়টুকু উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রত্যেকে নিজ নিজ সাধ্যমতো দেশের এই সংকটকালে, সংকট উত্তরণে যেন নিজ নিজ মেধা সাধ্যমতো কাজে লাগাতে পারি, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব।’
নির্বাচন কমিশনকে সংস্কার করে যে কোনো সময় আদর্শ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রাখা হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।’
ধৈর্য্য ধারণের আহ্বান
সবাইকে ধৈয্য ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা, তা থেকে বের হতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, জুলাই-আগস্ট মাসে গণ-অভ্যুথানে বল প্রয়োগ ও হতাহতের ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্তের প্রক্রিয়া এ সপ্তাহেই শুরু হবে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে দায়ের করা শত শত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার বেশির ভাগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আটক ছাত্র–জনতার মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মিথ্যা ও গায়েবি সব মামলার ক্ষেত্রে একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গণ-অভ্যুথানে সকল শহীদের পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। সকল আহত শিক্ষার্থী ও জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন হবে
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থপাচার ও জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি সাক্ষর প্রকল্পের নামে লুটপাট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়নের জন্য ইতিমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, অন্তবর্তী সরকারের সব উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাঁদের সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করবেন। পর্যায়ক্রমে এটি সকল সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও নিয়মিত এবং বাধ্যতামূলক করা হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে প্রতিশ্রুত ন্যায়পাল নিয়োগে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হবে।
ব্যাংক কমিশন
লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা স্থাপন, ব্যবসা বাণিজ্যের সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং জনগণের জীবনযাপন সহজ করতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ সচল করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা হবে। আর্থিক খাতে সার্বিক পরিস্থিতি এবং সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে দ্রুত প্রকাশ করা হবে। শেয়ারবাজার, পরিবহন খাতসহ যেসব ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে জনমুখী ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে পুলিশ কমিশন গঠন করা হবে। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল সংস্থা ও জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কমিশনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে।
তিনি বলেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবকে গুম–নির্যাতনের কাজে লাগিয়ে তাদের কলঙ্কিত করা হয়েছে। তারা দেশের গৌরব। তাদের কিছু অতি উৎসাহী সদস্যের কারণে পুরো বাহিনীকে আমরা কলঙ্কিত দেখতে চাই না। আমরা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে চাই এবং তাদের শাস্তি দিতে চাই। যেন ভবিষ্যতে কারও হুকুমে দেশপ্রেমিক কোনো বাহিনীর, পুলিশের, র্যাবের কোনো সদস্য হত্যাকাণ্ড, গুম ও অত্যাচারে জড়িত হওয়ার সাহস না করে।
দেশরক্ষা বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সব বাহিনীর মধ্যে যারা হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন বা শারীরিক, মানসিক অত্যাচারে সরাসরি জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
বন্যা পরিস্থিতি
চলমান বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বন্যা কবলিত এলাকার সব মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের সঠিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারের যত কার্যক্রম আছে সব সচল করা হয়েছে। বন্য–পরবর্তী কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য করণীয় কী তা স্থির করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারের একটি লক্ষ্য হবে বিদেশগামী এবং প্রত্যাবর্তনকারী প্রত্যেক প্রবাসী শ্রমিককে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে দেশে আসা এবং যাওয়া নিশ্চিত করা। সে ব্যাপারে শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সহযোগিতা কামনা
সবার সহযোগিতা চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশেপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না।